১লা জুলাই: জাতীয় ডাক্তার দিবস

ডঃ বিধান চন্দ্র রায়: এক অসাধারণ জীবন ও কর্মের পথ
ডঃ বিধান চন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২) ছিলেন একাধারে একজন কিংবদন্তি চিকিৎসক, একজন নিবেদিতপ্রাণ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং একজন দক্ষ প্রশাসক। তাঁর কর্মজীবন ছিল বহুমুখী এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষাজীবন: ১৮৮২ সালের ১লা জুলাই বিহারের বাঁকিপুরে এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিধান চন্দ্র রায়। তাঁর পিতা ছিলেন প্রকাশচন্দ্র রায় এবং মাতা অঘোরকামিনী দেবী। মেধাবী ছাত্র বিধানচন্দ্র পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরে পাটনা কলেজে গণিত নিয়ে স্নাতক হন। এরপর তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ১৯০৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।
উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় আগমন: ১৯১১ সালে ডঃ রায় উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস (লন্ডন) এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস (ইংল্যান্ড) থেকে একযোগে এমআরসিপি (MRCP) ও এফআরসিএস (FRCS) ডিগ্রি অর্জন করেন, যা ছিল তাঁর অসাধারণ মেধা ও অধ্যবসায়ের পরিচায়ক। বলা হয়, একই সময়ে এই দুটি ডিগ্রি অর্জনকারী তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ভারতীয়। দেশে ফিরে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও পরে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ (বর্তমানে আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ) এবং ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ)-এ শিক্ষকতা করেন। তাঁর হাতে বহু কৃতী চিকিৎসক তৈরি হয়েছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদন: চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি ডঃ রায় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৩০ সালে কলকাতার মেয়র হন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং কারাবরণও করেন। মহাত্মা গান্ধী নিজেই তাঁর চিকিৎসার জন্য ডঃ রায়ের ওপর গভীর আস্থা রাখতেন। তাঁর দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত এবং তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের সেবা করার জন্য রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মও গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গের স্থপতি মুখ্যমন্ত্রী: স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৬ বছর বয়সে এই দায়িত্ব নেওয়া সত্ত্বেও, তিনি তাঁর দীর্ঘ ১৪ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে (১৯৪৮-১৯৬২) পশ্চিমবঙ্গের পুনর্গঠনে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ও অবকাঠামো খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে দুর্গাপুর ইস্পাত নগরী, কল্যাণী শহর, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল, দুর্গাপুর ব্যারাজ, কোপার্সের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স - এগুলি সবই তাঁর স্বপ্ন ও প্রচেষ্টার ফসল। তিনি রাজ্যের প্রধান নদীগুলির বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও নজর দেন।
জাতীয় ডাক্তার দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
১৯৯১ সাল থেকে ভারত সরকার ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেশের সমস্ত চিকিৎসকদের আত্মত্যাগ ও সেবাকে সম্মান জানাতে ১লা জুলাইকে জাতীয় ডাক্তার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটি নিম্নলিখিত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
চিকিৎসকদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা: এই দিনে আমরা সেই সমস্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষের জীবন রক্ষা করেন এবং সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়তা করেন। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর মতো বিপর্যয়কালে চিকিৎসকদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করবে। তাঁরাই ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা।
চিকিৎসা পেশার মহত্ত্বের প্রচার: এই দিনটি চিকিৎসা পেশার মহত্ত্ব এবং সমাজে এর অপরিহার্য ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়। এটি নতুন প্রজন্মকে এই noble পেশায় আসার জন্য উৎসাহিত করে।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের আদর্শের অনুপ্রেরণা: ডঃ রায়ের জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, জননেতা এবং দেশপ্রেমিকের আদর্শ অনুসরণ করা আমাদের সকলের কর্তব্য। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একজন ব্যক্তি একই সাথে চিকিৎসা, রাজনীতি এবং সমাজসেবার মাধ্যমে দেশের সেবা করতে পারেন।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অসাধারণ অবদান
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের অবদান কেবল একজন চিকিৎসক বা রাজনীতিবিদ হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদর্শী, যিনি বাংলার স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান নিচে উল্লেখ করা হলো:
চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের স্থাপন: তিনি পশ্চিমবঙ্গে একাধিক চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। এর মধ্যে আর.জি. কর মেডিকেল কলেজ, নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ এবং চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা: মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করার জন্য একাধিক প্রকল্প হাতে নেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করাই ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রের উন্নয়ন: চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল, যা পূর্বে দেশবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল নামে পরিচিত ছিল, এটি ডঃ রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া তিনি রাজ্যের অন্যান্য হাসপাতালগুলির আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণে জোর দেন।
রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা: তিনি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছিলেন এবং রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
১লা জুলাই জাতীয় ডাক্তার দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানবসেবায় চিকিৎসকদের ভূমিকা কতটা অপরিসীম। ডঃ বিধান চন্দ্র রায় তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং জনসেবার মানসিকতা নিয়ে যে কোনো কঠিন লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। তাঁর জীবন আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে আমরা এক সুস্থ ও সমৃদ্ধ ভারত গড়তে পারি, যেখানে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্র (References):
National Doctor's Day 2024: History, Significance and Celebrations - The Economic Times
Biography of Dr. Bidhan Chandra Roy - West Bengal Legislative Assembly
Doctor's Day: Remembering Dr Bidhan Chandra Roy, a great physician & freedom fighter - India Today