চিকিৎসা বিজ্ঞান মানব সভ্যতার এক অনন্য অর্জন, যা হাজার বছরের গবেষণা, আবিষ্কার ও উন্নতির ফল। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রোগের কারণ ও প্রতিকার খুঁজতে চেষ্টা করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে, যা মানুষের গড় আয়ু ও জীবনমান বাড়িয়েছে। এই প্রবন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস, এর বিবর্তন, গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ও বর্তমান অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
প্রাচীন যুগের চিকিৎসা
মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতা
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০-২০০০) রোগের কারণ হিসেবে দেবদেবী বা অশুভ শক্তিকে দায়ী করা হতো। প্রাচীন মিশরে চিকিৎসা অনেকটা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে এখানকার চিকিৎসকরা কিছু ওষুধ ও শল্যচিকিৎসা পদ্ধতির ব্যবহার জানতেন। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত চিকিৎসক ইমহোতেপ (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫০) ইতিহাসের অন্যতম প্রথম চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত।
ভারত ও চীন
ভারতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০) ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সুশ্রুত ও চরক ছিলেন প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসক। সুশ্রুত সংহিতায় শল্যচিকিৎসার (সার্জারি) বিবরণ পাওয়া যায়, যেখানে প্লাস্টিক সার্জারিরও উল্লেখ আছে।
প্রাচীন চীনে আকুপাংচার ও হার্বাল মেডিসিন ব্যবহারের প্রচলন ছিল। চীনা চিকিৎসক হুয়াং ডি-এর "নেইজিং" নামক গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন দলিল।
গ্রিক ও রোমান চিকিৎসা
গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব) রোগের কারণ খুঁজতে "হিউমর থিওরি" (রক্ত, পীত পিত্ত, কালো পিত্ত ও কফ) প্রচলন করেন। তিনি শপথবাক্য "হিপোক্রেটিক ওথ" প্রবর্তন করেন, যা এখনো চিকিৎসকদের জন্য নৈতিক দিকনির্দেশনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রোমান চিকিৎসক গ্যালেন (১৩০-২১০ খ্রিস্টাব্দ) চিকিৎসা বিজ্ঞানে শল্যচিকিৎসার ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করেন এবং শারীরবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন।
মধ্যযুগের চিকিৎসা
ইসলামী স্বর্ণযুগের চিকিৎসা
৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম চিকিৎসকরা চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী অবদান রাখেন।
- আল-রাজি (৮৬৫-৯২৫) প্রথমবারের মতো গুটিবসন্ত ও হাম সম্পর্কে পার্থক্য নির্ণয় করেন।
- ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) তার রচিত "কানুন ফি আল-তিব্ব" (The Canon of Medicine) বহু শতাব্দী ধরে চিকিৎসাবিদ্যার মানদণ্ড ছিল।
- আল-জাহরাভি (৯৩৬-১০১৩) আধুনিক শল্যচিকিৎসার (সার্জারি) অন্যতম পথিকৃৎ।
পুনর্জাগরণ ও আধুনিক চিকিৎসার সূচনা
১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে ইউরোপে বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ ঘটে।
- আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস (১৫১৪-১৫৬৪) মানবদেহের শারীরবিদ্যার (anatomy) ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন ভিত্তি স্থাপন করেন।
- উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭) রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসাবিজ্ঞান
জীবাণু তত্ত্বের আবিষ্কার
- লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫) জীবাণুর মাধ্যমে রোগ সংক্রমণের তত্ত্ব প্রমাণ করেন এবং পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
- রবার্ট কচ (১৮৪৩-১৯১০) ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে যক্ষ্মা, কলেরা ও অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ আবিষ্কার করেন।
অ্যানেস্থেশিয়া ও অস্ত্রোপচার
- ১৮৪৬ সালে উইলিয়াম টি.জি. মর্টন সফলভাবে ইথার অ্যানেস্থেশিয়া ব্যবহার করেন।
- ১৮৬৭ সালে জোসেফ লিস্টার জীবাণুনাশক পদ্ধতি ব্যবহার করে অস্ত্রোপচার নিরাপদ করেন।
প্রতিষেধক ও অ্যান্টিবায়োটিক
- ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন।
- ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন, যা অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার সূচনা করে।
আধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অগ্রগতি
গণ-স্বাস্থ্য ও টিকাদান কর্মসূচি
- ২০শ শতাব্দীতে পোলিও, গুটি বসন্ত, হেপাটাইটিস-বি ইত্যাদির টিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হয়।
- ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষণা করে যে গুটি বসন্ত পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে।
গবেষণা ও জিনতত্ত্ব
- ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ-এর গঠন আবিষ্কার করেন, যা আধুনিক জেনেটিক্সের ভিত্তি তৈরি করে।
- ২০০৩ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্প সম্পন্ন হয়, যা ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি
- এমআরআই (MRI), সিটি স্ক্যান (CT Scan), এক্স-রে ইত্যাদি প্রযুক্তি রোগ নির্ণয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
- ল্যাপারোস্কোপি ও রোবটিক সার্জারি অস্ত্রোপচারকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করেছে।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস এক দীর্ঘ ও ক্রমাগত বিবর্তনের পথ। অতীতের চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে শুরু করে আজকের উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসা পর্যন্ত এই অগ্রগতি মানবজাতির এক বিশাল অর্জন। ভবিষ্যতে জিন থেরাপি, কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও উন্নত ব্যবহার চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
Post a Comment