
১. সংক্রমণ ও চিকিৎসার প্রাথমিক ইতিহাস
১.১ সংক্রমণ রোগ ও মানব সভ্যতা
সংক্রমণজনিত রোগ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। প্লেগ, যক্ষ্মা, গ্যাংগ্রিন, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের সঠিক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি ছিল।
১.২ জীবাণু তত্ত্ব ও সংক্রমণ
লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) জীবাণু তত্ত্ব (Germ Theory) প্রচার করেন এবং প্রমাণ করেন যে ব্যাকটেরিয়া রোগ সৃষ্টি করতে পারে। রবার্ট কচ (Robert Koch) নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টি করে তা গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন। তবে, তখন পর্যন্ত কার্যকর ব্যাকটেরিয়ানাশক ওষুধের সন্ধান মেলেনি।
২. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এবং পেনিসিলিনের আবিষ্কার
২.১ ফ্লেমিংয়ের পটভূমি
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (Alexander Fleming) একজন স্কটিশ ব্যাকটেরিয়োলজিস্ট ছিলেন। তিনি লন্ডনের সেন্ট ম্যারি’স হাসপাতালের ব্যাকটেরিয়া গবেষণা ল্যাবে কাজ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈন্যদের সংক্রমণজনিত সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ করে তিনি সংক্রমণবিরোধী ওষুধ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
২.২ ১৯২৮ সালের দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কার
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লেমিং স্ট্যাফিলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ছুটিতে যাওয়ার আগে তিনি ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ কিছু পেট্রি ডিস রেখেছিলেন। ফিরে এসে তিনি লক্ষ্য করলেন যে Penicillium notatum নামে এক ধরনের ছাঁচ ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই ঘটনাটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করল।
২.৩ পেনিসিলিন নামকরণ ও প্রাথমিক পরীক্ষা
ফ্লেমিং ছাঁচ থেকে নিঃসৃত পদার্থকে "পেনিসিলিন" নাম দেন। পরীক্ষাগারে তিনি দেখতে পান এটি স্ট্যাফিলোকক্কাসসহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ১৯২৯ সালে "British Journal of Experimental Pathology"-তে তিনি তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
২.৪ পেনিসিলিন বিশুদ্ধকরণের সমস্যা
ফ্লেমিং পেনিসিলিনের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকলেও এটি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারেননি। ফলে তার আবিষ্কার তখনকার চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
৩. হাওয়ার্ড ফ্লোরি, এর্নেস্ট চেইন এবং পেনিসিলিনের বিশুদ্ধকরণ
৩.১ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দল
১৯৩৮ সালে হাওয়ার্ড ফ্লোরি (Howard Florey) এবং এর্নেস্ট চেইন (Ernst Chain) অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পেনিসিলিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন নরম্যান হিটলি (Norman Heatley), যিনি বিশুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
৩.২ পেনিসিলিনের বিশুদ্ধকরণ ও প্রাণীদেহে পরীক্ষা
১৯৪০ সালে তারা প্রথমবারের মতো পেনিসিলিন বিশুদ্ধ করেন এবং এটি প্রাণীদেহে প্রয়োগ করেন। সংক্রমিত ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তারা সফল হন।
৩.৩ প্রথম মানবদেহে পরীক্ষা
১৯৪১ সালে অ্যালবার্ট আলেকজান্ডার (Albert Alexander) নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার সংক্রমণ নিরাময়ে প্রথমবারের মতো পেনিসিলিন প্রয়োগ করা হয়। তবে, ওষুধের অপ্রতুলতার কারণে পুরো চিকিৎসা সম্ভব হয়নি এবং তিনি মারা যান। এরপর আরও গবেষণা চালিয়ে ব্যাপক উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়।
৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদন
৪.১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকার যৌথভাবে পেনিসিলিন উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। **ফাইজার (Pfizer), মের্ক (Merck), এলি লিলি (Eli Lilly)**সহ বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি এটি উৎপাদনে যোগ দেয়।
৪.২ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের সফলতা
১৯৪৪ সালে নরম্যান্ডি অভিযানের সময় আহত সৈন্যদের সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৫. পেনিসিলিন পরবর্তী যুগ ও চিকিৎসায় বিপ্লব
৫.১ অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার
পেনিসিলিনের সফলতার পর অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিকের গবেষণা ত্বরান্বিত হয়। ১৯৪৩ সালে সেলম্যান ওয়াক্সম্যান (Selman Waksman) স্ট্রেপ্টোমাইসিন (Streptomycin) আবিষ্কার করেন, যা যক্ষ্মার চিকিৎসায় কার্যকর। পরবর্তী সময়ে টেট্রাসাইক্লিন, ক্লোরামফেনিকল, এরিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়।
৫.২ আধুনিক চিকিৎসায় পেনিসিলিনের ভূমিকা
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যেমন নিউমোনিয়া, সিফিলিস, গ্যাংগ্রিন ইত্যাদির চিকিৎসায় এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আজকের দিনে আধুনিক সেমি-সিন্থেটিক পেনিসিলিন তৈরি করা হয়, যা বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর।
৬. অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
৬.১ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (Antibiotic Resistance)
অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে কিছু ব্যাকটেরিয়া পেনিসিলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। Methicillin-resistant Staphylococcus aureus (MRSA) এর একটি উদাহরণ।
৬.২ ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
- নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের গবেষণা
- অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ
- বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন
পেনিসিলিনের আবিষ্কার মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি। এটি সংক্রমণজনিত রোগের চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র (References)
- Fleming, A. (1929). British Journal of Experimental Pathology, 10(3), 226–236.
- Chain, E., Florey, H. W., et al. (1940). The Lancet, 236(6104), 226–228.
- Wainwright, M. (1990). Journal of Medical Biography, 8(1), 56–61.
- World Health Organization (WHO), Penicillin and Antibiotic Resistance.
- Centers for Disease Control and Prevention (CDC), History of Antibiotics.
Post a Comment